জিপিএস (GPS) অর্থাৎ গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে যোগ করেছে এক নতুন মাত্রা। জিপিএস পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় নিমেষেই আমাদের অবস্থান শনাক্ত করতে পারে ও সঠিক গন্তব্যে পৌঁছার দিকনির্দেশনা দিতে পারে। জিপিএসের ব্যবহার আজকাল সর্বত্র। আকাশপথে উড্ডয়নরত বিমান থেকে শুরু করে আমাদের ব্যক্তিগত গাড়ি ও কৃষিক্ষেত্রেও আমরা জিপিএস ব্যবহার করি। এ ছাড়া আজকাল প্রায় সব মোবাইল ফোন এমনকি ডিজিটাল ক্যামেরাতেও জিপিএস সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। গবেষকেরা এখন পরবর্তী প্রজন্মের জিপিএসকে আরও নিখুঁত ও নির্ভুল করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে জিপিএস প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে কিছু মৌলিক ধারণা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জিপিএসের কিছু সম্ভাব্য ফিচার নিয়ে আলোচনা করছি।
জিপিএস সেবা প্রদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সর্ব প্রথম ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মহাশূন্যে স্থাপন করে কৃত্রিম স্যাটেলাইট। বর্তমানে জিপিএসের জন্য বরাদ্দকৃত মোট স্যাটেলাইটের সংখ্যা ৩১টি। যেগুলো প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার উচ্চতায় প্রতি ঘণ্টায় ১৪ হাজার কিলোমিটার বেগে সার্বক্ষণিক পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। এর মধ্যে সাতটি স্যাটেলাইট ব্যাকআপের জন্য সংরক্ষিত আছে আর যোগাযোগের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ২৪টি। পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে যেকোনো সময়ে আমাদের জিপিএস ডিভাইস অর্থাৎ রিসিভার কেবল একই সঙ্গে চারটি টি স্যাটেলাইট থেকে সিগনাল গ্রহণ করে। স্যাটেলাইটের প্রেরিত সিগনাল এক ধরনের বেতার তরঙ্গ যেটা আলোর সমান গতিতে দূরত্ব অতিক্রম করে। প্রতিটি স্যাটেলাইটের সংকেত তাদের বর্তমান অবস্থান ও সংকেত প্রেরণের সময়কাল জিপিএস রিসিভারকে জানিয়ে দেয়। রিসিভার তখন d = v X t (অর্থাৎ, দূরত্ব=বেগ X সময়)—এই সরল সমীকরণ ব্যবহার একটি স্যাটেলাইট থেকে তার দূরত্ব হিসাব করে। একই পদ্ধতির মাধ্যমে পর পর চারটি স্যাটেলাইট থেকে রিসিভারের দূরত্ব পরিমাপ করা হয়। এই দূরত্বকে ব্যবহার করে স্যাটেলাইটগুলো রিসিভারের অবস্থানকে ত্রিমাত্রিক বলয়ের (Sphere) মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। এভাবে চারটি স্যাটেলাইট চারটি পৃথক বলয় তৈরি করে। বলয়গুলো জিপিএস রিসিভারের অবস্থানকে লক্ষ্যবস্তু ধরে পরস্পরকে ছেদ করে। বলয়গুলো এমনভাবে ছেদ করে যেন ছেদবিন্দুটিই হয় পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান। এই পদ্ধতিকে ট্রাইল্যাটারেশন (Trilateration) বলা হয়। ট্রাইল্যাটারেশনের জন্য তিনটি স্যাটেলাইট যথেষ্ট হলেও চতুর্থ স্যাটেলাইটটি মূলত ব্যক্তি অথবা বস্তুর অবস্থানকে আরও যথাযথ করতে সাহায্য করে। প্রতিটি জিপিএস রিসিভারেই ডিজিটাল ম্যাপ সংযোজিত আছে। জিপিএস থেকে প্রাপ্ত তথ্য ম্যাপের সঙ্গে সিনক্রোনাইজড করে আমরা পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকেই আমাদের বর্তমান স্থান ও ঠিকানা জানতে পারি। আধুনিক জিপিএস ব্যবস্থা বেশ নির্ভরশীল হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়ে গেছে। গবেষকেরা সেগুলো কাটিয়ে উঠে আরও চমকপ্রদ কিছু ফিচার ও সুবিধা সংযোজন করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে হলো প্রধান দুটি ফিচার হলো জিপিএস ব্লক IIIA ও এল-২ সি।
জিপিএস ব্লক IIIA (GPS block IIIA): যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা স্যাটেলাইট নির্মাতা কোম্পানি লকহিড মার্টিনের (Lockheed Martin) তত্ত্বাবধানে চলছে স্যাটেলাইট আধুনিকায়নের কাজ। ব্লক IIIA-এর সফল বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে ২০১৭ সালের মধ্যে এটার আনুষ্ঠানিক সম্প্রচার চালু হবে। উদ্যোক্তাদের ধারণা নতুন প্রজন্মের এই স্যাটেলাইট অত্যধিক নির্ভুলভাবে মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছার দিকনির্দেশনা দিতে পারবে ও নিজস্ব অবস্থান সম্পর্কে আরও সঠিক তথ্য দিতে পারবে। মহাশূন্যে স্থাপিত স্যাটেলাইট থেকে পাঠানো নেভিগেশন সিগনাল বিভিন্ন মাধ্যম দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে খারাপ আবহাওয়া এই সমস্যার জন্য দায়ী। এতে করে একজন জিপিএস গ্রাহক নিজের অবস্থান সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ভুল তথ্য পেতে পারেন। নতুন নির্মিত স্যাটেলাইটে স্পেস সেগমেন্ট, কন্ট্রোল সেগমেন্ট ও ইউজার সেগমেন্ট নামে তিনটি অতিরিক্ত সুবিধা চালু হচ্ছে, যেটা লাগাতার ২৪ ঘণ্টা যেকোনো আবহাওয়ার মধ্যে আমাদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে অত্যন্ত সূক্ষ্ম আপডেট দিতে পারবে। তা ছাড়া এই নেটওয়ার্কের আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে এটি একই সঙ্গে অসংখ্য গ্রাহক ও এলাকা সংযুক্ত করতে পারে।
এল-২ সি (L2 C): এল-২ সি মূলত একধরনের অতি উন্নত নেভিগেশন সংকেত। এটা পুরাতন এল-১ সি/এ (L1 C/A)-এর নতুন সংস্করণ। এল-২ সি হবে অতি শক্তিশালী ও যেকোনো ভৌগোলিক পরিবেশে কার্যকর। বর্তমানে বেশির ভাগে ডিভাইসে ব্যবহৃত এল-১ সি/এ-এর একটি বড় সমস্যা হলো এটা আয়নমন্ডল দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়ে পৃথিবীতে পৌঁছতে বিলম্বিত হয়। যেটাকে আয়নস্ফিয়ারিক ডিলেই (Ionospheric delay) বলা হয়। অন্যদিকে এল-২ সি এই সমস্যা লাঘব করে দ্বিগুণ কার্যকরী হতে পারে। দুর্গম এলাকা, গাছপালা ও বন-জঙ্গল দ্বারা পরিবেষ্টিত অঞ্চল এমনকি গৃহ অভ্যন্তরে যেকোনো জায়গায়ও এল-২সি আমাদের জিপিএস রিসিভারে পরিষ্কার সংকেত পাঠাতে সক্ষম হবে। এল-২ সি এর পাশাপাশি এল-১সি (L1 C) এবং এল-৫ (L5) নামে আরও দুটি নতুন নেভিগেশন সিস্টেম উন্নয়নের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে, যেগুলো সব মিলিয়ে আনুমানিক ২০১৮ সাল নাগাদ কার্যকর হতে পারে |
সৌজন্যে: প্রথম আলো